রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৩

যে প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার....


আব্দুর রব সিদ্দিক রানা।
বয়স ২৫ বছর। সরকারী এডওয়ার্ড কলেজে অর্থনীতির অনার্সের ছাত্র ছিলো। বছর খানেকের মধ্যেই যার অনার্স সম্পন্ন হতো। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই ভালো একটি চাকরীও জুটে যেতে পারতো.....
পড়াশোনার পাশাপাশি, চাটমোহর রেজেস্ট্রি অফিসে কাজ করতো রানা। কিছুদিনের মধ্যে যার লাইসেন্স হবার কথা ছিলো। তাই ভালো কোন চাকরী না পেলেও বেশ ভালো ভাবেই তার জীবনটা চলে যেতে পারতো। যে জীবনে কোন অনিশ্চয়তা ছিলো না......

অথচ এ নিশ্চিন্ত জীবনটাই আজ সবকিছু পেছনে ফেলে, অনিশ্চিত এক জীবন এবং জগতে চলে গেছে!!!
কিন্তু কেন? এ বয়সে, এভাবে কেন চলে যেতে হবে?
এ কি প্রচন্ড অভিমান? নিদারুন হতাশা? প্রতারিত বেদনা? একই সাথে ছেলে মানুষি আর বোকামী...

এ কথা সত্যি যে, জীবনে এমন সময় আসতে পারে যখন সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায়, জীবন যখন মূল্যহীন হয়ে যায়, বেঁচে থাকা যখন অর্থহীন হয়ে পড়ে!
রানার ক্ষেত্রেও কি এমন সময় এসেছিলো? নাকি হতাশাময় সময়ের অতিমূল্যায়নে জীবনের অপচয় করেছে রানা?
এ অবধারিত প্রশ্নই, এক প্রানচ্ছোল তরুনের অকাল মৃত্যুতে শোকের পাশাপাশি তারুন্যের পিছলে পড়া মনোঃসমিক্ষনকে গুরুত্বপূর্ন করে তোলে। যে মনোঃসমিক্ষন, একটি নির্দিষ্ট বয়স থেকে কোন ছেলেকে কোন মেয়ের দিকে কিংবা কোন মেয়েকে কোন ছেলের দিকে টানে। যখন জীবনের অর্থ, সৌন্দর্য্য, সার্থকতা এককেন্দ্রিক হয়ে পরতে পারে! যখন জীবনের অপরাপর সুখ, স্বপ্ন, সফলতা অযৌক্তিকভাবেই মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে!
হয়তো রানার ক্ষেত্রেও এমনটিই হয়েছিলো!!!
যে মেয়েটিকে ভালোবেসেছিলো রানা। মেয়েটিও ভালবেসেছিলো রানাকে! দিন, মাস, বছরের হিসাবে যে সম্পর্কটি দীর্ঘ সময়ে গড়িয়েছিলো। মেয়েটি হঠাৎ করে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো! প্রত্যাহার করেছিলো- ভালোবাসা থেকে, স্বপ্ন থেকে, একটি পরিনতি থেকে......
মেয়েটির এ অবস্থানে হয়তো, পারিবারিক এবং সামাজিক সংগত কারন থাকতে পারে! কিন্তু এ সংগত কারন ও আপত সঠিক সীদ্ধান্ত নেবার আগে কেটে গেছে ৪-৫ বছর! যে সময়ে তৈরী হয়েছে অনেক সুখস্মৃতি, লেনদেন হয়েছে অজস্র প্রতিশ্রুতি। সে সময়ে তৈরী হওয়া আস্থা, বিশ্বাস, মানুষিক নির্ভরতাকে কোন ভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
একটি ছেলে কিংবা মেয়ের জীবনে এমন আকর্ষিক বিপরীতমূখি সীদ্ধান্ত যে কি ভয়াবহ মানষিক প্রতিক্রিয়া তৈরী করতে পারে, তার এক ভয়াবহ সর্বোচ্চ রুপ আমরা দেখলাম রানার ক্ষেত্রে।

আমি আশা করছি- প্রেম প্রত্যাশি কোন তরুন, এবং সম্মতির হাসি হাসার আগে কোন তরুনী এ বিষয়গুলো মাথায় রাখবে। যারা প্রেম করবে জীবনকে অর্থবহ করার জন্য, জীবনকে মূল্যহীন করার জন্য নয়।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, রানাতো জীবনকে অর্থবহ করতে চেয়েছিল, তবে তার এমন পরিনতি কেন?
মূলত, রানার তীব্র ভালোবাসার বিপরিতে মেয়েটির আবেগীয় পর্যায়ের ভালোবাসা অবধারিতভাবে বিচ্ছেদের দিকে গড়িয়েছে! যা কিনা রানার মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘ দিনের প্রেম ভেঙ্গে যাওয়া, কাছের মানুষকে না পাওয়া, তাকে নিয়ে তৈরী হওয়া স্বপ্ন জগত ভেঙ্গে যাওয়ায় যে হতাশার তৈরী হয়েছে। যা সময়ের ব্যবধানে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। এ হতাশাকে, অপ্রাপ্তির বেদনাকে কন্ট্রোল করতে না পারা। ছেলে মানুষি অভিমানে, জীবনের মূল্য হারিয়ে ফেলার বোকামিতেই ঘটে গেছে এমন বাজে পরিনতি! তৈরী হয়েছে শূন্যতা, শূন্যতা তৈরী হয়েছে বাবা-মা, ভাই-বোন, নিকট স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের হৃদয়ে......

আমি ভাবছিলাম, প্রকৃতি তো শূন্যতা পছন্দ করে না। রানার অকাল মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরী হয়েছে তা কি কখনো পূরন হবে?
এ কথা ঠিক যে, আবার সবকিছু আগের মতোই চলবে! কিন্তু রানার মা-বাবা মনে যে শূন্যতা তৈরী হয়েছে তা কখনোই পূরন হবে না! প্রতিনিয়তই বিষয়টি তাদের কাঁদাবে, তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়বে...
বন্ধুরা আবার আগের মতোই আড্ডা দেবে! মুখরিত আড্ডার এক পর্যায়ে হঠাৎ সবাই নিরব হয়ে যাবে, "ইশ আজ যদি রানা থাকতো"!

বোকা রানা, একজনের ভালোবাসাহীনতায় জীবনের মূল্য হারিয়ে ফেললো! অথচ মা-বাবার চোখের জলের মূল্য, বন্ধুদের নিরবতার মূল্য সে বুঝলোই না! বুঝলো না, জীবনের দু-একটি অধ্যায় বাদ দিলে জীবন অনেক সৌন্দর্য্যময়, অনেক অর্থবহ......


লেখাটি এখানেই শেষ হতে পারতো!!!
লেখাটি লিখেছিলাম- রানার মৃত্যুর পরের দিন।

সে সময় আমার ধারনায়, বেদনাদায়ক এ ঘটনার ব্যাখ্যা ছিলো- মেয়েটির নিজেকে প্রত্যাহার করার ফলশ্রুতিতে এটা রানার ভয়াবহ মানুষিক প্রতিক্রিয়ায় জীবনের অপচয়!
একটি জীবন এভাবে অকালে ঝড়ে যাওয়ার তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় এটাই ছিলো আমার, হয়তো অনেকেরই এক লাইনের মূল্যায়ন!
কিন্তু জীবন অনেক বড়। জীবনের অনেক কিছুই অনেকের কাছেই অজানা থেকে যায়। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই উঠে আসে যা স্বাভাবিকতার সাথে যায় না, তাৎক্ষনিক ভাবে নির্মোহ বিশ্লেষনও করা যায় না!

বিশ্লেষন করা যায় না বলেই, তাৎক্ষনিকভাবে মেয়েটির বিপরীতমূখি অবস্থানকে প্রত্যাহার বলতে হয়! প্রতারনা বলা যায় না।
কিন্তু এটা প্রত্যাহার ছিলো না, এটা ছিলো প্রতারনা!
একটি সম্পর্ক সেটা যত দীর্ঘই হোক, বাস্তবতার নিরিখে প্রত্যাহার মেনে নেয়া যায় কিন্তু প্রতারনা কখনোই না।
নিজেকে প্রত্যাহার করার পেছনে থাকতে পারে পারিবারিক ও সামাজিক সংগত কারন। কিন্তু প্রতারনার পেছনে সংগত কারন থাকে না। প্রতারনা সংগঠিত হয় একজনকে প্রতারিত করে, নিঃস্ব করে।
রানাও প্রতারিত হয়েছিলো, নিঃস্ব হয়েছিলো!
যে মেয়েটিকে ভালোবেসেছিলো রানা। গত জানুয়ারীতেই সে ১৮ বছরে পা দিয়েছে। দীর্ঘ দিনের আস্থা, বিশ্বাস, মানুষিক নির্ভরতায় তারা যে চুরান্ত পরিনতির দিকে এগোচ্ছিলো তা এ জানুয়ারীকে ঘিরেই।
কিন্তু পরিনত বয়স আর পরিনতির কাছাকাছি এসেই মেয়েটি হঠাৎ নয় বরং ধিরে ধিরে পাল্টাতে থাকে। পাল্টায় তার রিলেশন স্ট্যাটাস, শো করতে থাকে রাতের পর রাত ওয়েটিং। তারপরও বিভিন্ন অযুহাতে চলতে থাকে ভালোবাসার অভিনয়। স্বপ্ন গড়তে থাকে, কিংবা স্বপ্ন গড়ার সহযোগী হয় পরিনত বয়সের পরিনতির।
কিন্তু পরিনত বয়সে এসেই মেয়েটি পরিপূর্ন পাল্টে যায়! আর তত দিনে বিয়ের একরকম গোপন প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলো রানা। বানিয়ে ফেলেছিলো বিয়ের পোশাক!
একটি ছেলের এভাবে স্বপ্ন জগৎ ভেঙ্গে যাওয়ায় জীবনের মূল্য হারিয়ে ফেলা, কি খুবই অস্বাভাবিক?
বিষয়টি স্বাভাবিক কি অস্বাভাবিক, স্বাভাবিক হলেও কতটুকু স্বাভাবিক? এ প্রশ্নের চেয়েও বড় প্রশ্ন-
মেয়েটি পরিনয়ের জন্য আইনসিদ্ধ বয়স ১৮তে পা দিয়েছিলো জানুয়ারীর মাঝামাঝিতে। ধারনা করা যায়, প্রতিশ্রুত বিয়ের জন্য রানা চাপ দিয়েছিলো তখনই এবং মেয়েটিও চুরান্ত প্রতারনা করেছিলো সে সময়েই! অর্থ্যাৎ প্রেমটা ভেঙ্গেছিলো জানুয়ারীর মাঝামাঝি সময়ে! হতাশাগ্রস্থ আবেগে রানার আত্বহত্যা করলে তো সে সময় করার কথা! কিংবা সেটা হতে পারতো ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে, মার্চের শেষ সপ্তাহে কেন? এত দীর্ঘ সময় ধরে কি আত্বহত্যার মতো আবেগ ধরে রাখা যায়? কি ঘটেছিলো মধ্যবর্তি এ সময়ে? কি ঘটেছিলো শেষ সময়ে?
শেষ সময়ের কথা আসলে, যে কথাটি যোগ করা দরকার- রানার লাশ পাওয়া গিয়েছিলো রাজশাহীর পদ্মার চরে!
আমি ভাবছিলাম- আত্বহত্যার জন্য তো চাটমোহরেই অনেক জায়গা আছে! সেটা রেখে রাজশাহী কেন? এর একটা সরল জবাব হচ্ছে- মেয়েটি রাজশাহীতে পড়তো, সম্ভবত এ কারনেই!
তার মানে মেয়েটির সাথে শেষ মুহূর্তে রানার যোগাযোগ হয়েছিলো! কি ঘটেছিলো সে সময়?

আমি মনে করি এ প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। এ প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার সেই বাবা-মার জন্য যারা সন্তান হারিয়েছেন. সেই ভাই-বোনের জন্য যারা ভাই হারিয়েছেন, সেই শুভাকাংক্ষির জন্য যারা বন্ধুদের হারিয়েছেন...তারা সবাই যা হারিয়েছেন তা আর কখনোই ফিরে আসবে না! তবে এ প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার যে উত্তর অন্তত সান্তনা নিয়ে আসবে....
এ প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার, সমাজের জন্যও! যেন আর কোন ছেলে ও মেয়ের জীবনে এমন না ঘটে.......

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন