শনিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১২

সহস্র ও দুই রাত্রি



আকর্ষণীয় রজনীর নিদারুণ বিকৃতি

রাত্রি নেমেছে শরতের আকাশে, যে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে কাশফুলের মত মেঘ। রাত্রি নেমেছে সে শরতের মেঘেও।
এভাবেই সহস্র কাল ধরে রাত্রি নামছে শরৎ এবং বর্ষায়। আরব এবং বাংলায়।
তবে বিশেষ কারণেই বিশেষায়িত হয় একে থেকে অন্য।
তাইতো বর্ষার আকাশ থেকে সুন্দর শরতের আকাশ, বাংলার রজনীর থেকে আকর্ষণীয় আরব্য রজনী।
যে আকর্ষণেই ছোটবেলায় প্রতীক্ষায় থাকতাম সে রাতের জন্য যে রাতে টিভিতে আলিফ লায়লা প্রচারিত হতো। ছোটবেলায় শোনা সে সুর এখনো আমার কানে বাজে-
“আলেফ লায়লা, আলেফ লায়লা, ওয়া লায়লা, শোনো সব নতুন কাহিনী, মন ভরে যায় যার বাণী, কতযুগ পেড়িয়ে গেছে, সময় তবু রয়ে গেছে........”


যদিও সময় রয়ে যায়নি। বরং যুগ পেরেনোর সাথে সাথে সময়ও পেড়িয়ে গেছে, অনেক কিছুই বিকৃত হয়ে গেছে। বিকৃত হয়েছে এটি নামেও!
আশ্চর্য মনে হলেও, উপন্যাসটি আলেফ লায়লা ওয়া লায়লা নয় বরং আলেফ লায়লা ওয়া লায়লানে। সহস্র ও এক রাত্রি নয় বরং সহস্র ও দুই রাত্রি।
আমি ভাবছিলাম আমরা না হয় অসভ্য, আমরা নিজস্ব প্রয়োজনে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাই। আমরা বিকৃতি করি মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা! বিকৃত করি স্বাধীনতার ঘোষকের নাম! এটা আমাদের অসভ্যতা!
কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব, তারা তো সভ্য। তারা কেন বিকৃত করলো বিশ্ব সাহিত্যের এ অমূল্য সম্পদ?

লোমহর্ষক বঙ্গীয় রজনী

আরবের হেরেমখানায় মদ পানরত বাদশা, আর মৃত্যু ভয়ে গল্পরত বেগম, সকালেই যার গর্দান যাবে- এমন রাত অনেক আগেই ফুরিয়েছে....। এখনকার রাত, আলো আধারী কোন এক নাইট ক্লাবের রাত! যেখানে সারাব আছে, সাবাবও আছে, শুধু গল্প নেই ...... গল্পের প্রয়োজনও নেই। এখনতো আইটেম সংয়ের যুগ!
তবে কল্পনাপ্রবণ মনের দুর্নিবার আকর্ষণে আমি ঢুকে পড়েছি বঙ্গীয় রজনীর এক হেরেমখানায়, যেখানে বাদশাকে গল্প শোনাচ্ছে তার বেগম- যে গল্প আলি বাবা আর চল্লিশ চোরের, চিচিং ফাক বলে গুপ্তধন সন্ধানের গল্প নয়। বরং এ গল্প হলমার্কের সোনালী ব্যাংক ফাক করে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের গল্প। যে গল্প দস্যু জিংগালু জংলার জঙ্গিপনার নয় বরং এ গল্প শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসপনার গল্প। আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ ছাপিয়ে যে গল্প পরমাশ্চর্য প্রদীপের ছোয়ায় শেয়ার বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ার গল্প! এভাবেই চলবে সহস্র কাল ধরে! প্রতি রাতেই নতুন নতুন গল্প.............কুইক রেন্টালে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ার গল্প! যুদ্ধাপরাধী দস্যুদের বিচার বানচাল করার ষড়যন্ত্র! ধর্মের দোহাইয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মন্দির, বাড়ি পোড়ানো অধর্মের গল্প!
আমি ভাবছিলাম, আরব্য রজনী আকর্ষণীয় তবে বঙ্গীয় রজনী অনেক বেশী লোমহর্ষক।


অবিক্রিত জনগনের হাসি!

বঙ্গীয় রজনীর প্রতিটি রাতে উঠে আসে জনগনের দুঃখ, বেদনার কাহিনী। যারা প্রবল উৎসাহে পরিবর্তনের জন্য ভোট দেয় এবং বারবার হতাশ হয়! পরিবর্তনের জন্য দেয়া দুই-তৃতীয়াংশ কিংবা তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা যেখানে পরিপূর্ণ ব্যর্থতায় পরিণত হয়। তাইতো বঙ্গীয় রজনীর কাহিনী হতাশার কাহিনী, যেখানে কষ্ট আছে-হাসি নেই! যেখানে আক্ষেপ নিয়ে বিবেক গেয়ে চলে- আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম.....
আর তাইতো হাসতে ভুলে যাওয়া জনগনের জন্য আজ রাতে বঙ্গীয় বেগম তার বাদশাকে শোনাচ্ছেন আলেফ লায়লা ওয়া লায়লানের সর্বশেষ গল্প জাহাকুল আবদ।
যদিও এ গল্প আমাদের প্রথম শুনিয়েছিলেন, ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান। আলেফ লায়লা ওয়া লায়লানের আসল পান্ডুলিপি থেকে তিনি 'ক্রীতদাসের হাসি' নামে অনুবাদ করেন জাহাকুল আবদ।

এ গল্পে পরাক্রমশালী বাদশা হারুনুর রশীদ রাতের ব্যবধানে হাবশী গোলাম তাতারিকে আমিরে পরিণত করেছিলেন এবং বাদী মেহেরজানকে বেগম বানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন একজন ক্রীতদাসের হাসি কিনতে। গল্পের শেষে গোলাম তাতারী হারুনুর রশীদকে বলেছিল-
“শোন, হারুনুর রশীদ। দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দী কেনা সম্ভব। কিন্তু- কিন্তু-ক্রীতদাসের হাসি না.............”


গল্পে ছেদ পড়ল বঙ্গীয় বাদশার অট্টহাসিতে...........

বাদশাঃ বেগম ...... সরাব খাচ্ছি আমি, আর সরাবি হয়ে উঠছো তুমি?

বেগমঃ আপনি বড্ড দুর্বোধ্য! ভাবকে আরো প্রসারিত করুন জাহাপনা!

বাদশাঃ বঙ্গীয় রজনীতে তুমি শোনাচ্ছো, আরব্য কাহিনী! এ কেমন তামাশা?

বেগমঃ এ তামাশা জনগনের ভাগ্য এবং ভবিষ্যতের সাথে তামাশা .... কখনো কখনো আরব্য রজনী একাকার হয় বঙ্গীয় রজনীতে! আরব সাগরের পানি মেশে ভারত মহাসাগরে।

বাদশাঃ আমার বিরক্তিতে তলোয়ার আর তোমার গর্দানের মাঝে হেয়ালী করো না বেগম!

বেগমঃ গোস্তাকী মাফ জাহাপনা, শওকত ওসমান ক্রীতদাসের হাসি লিখেছিলেন ১৯৬৩ সালে আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের যুগে। স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ধরা বাজিতে তিনি জিতেছিলেন। সে বছরই ক্রীতদাসের হাসি পেয়েছিল শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের পুরষ্কার! এ হাসি শুধু হাবশি গোলাম তাতারির হাসি নয়, এ হাসি ছিলো এ দেশের প্রতিটি নিপীড়িত মানুষের মুক্তি আকাঙ্খার। যারা বলছিলো- আইয়ুব খান, অস্ত্রের জোরে শাসন ক্ষমতা দখল করা যায়, কিন্তু জনগনের মুখে হাসি ফোটানো যায় না।

বাদশাঃ হুম, কিন্তু এখনতো দেশটা স্বাধীন হয়েছে, স্বৈরশাসনও বিদায় নিয়েছে। যদিও বিশ্ববেহায়া এক স্বৈরাচার ক্ষমতাসীনদের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে, তবুও দেশে গণতন্ত্রই চলছে। এখন এ গল্পের প্রাসঙ্গিকতা কি?

বেগমঃ প্রাসঙ্গিকতা জনগনের হাসিতে জাহাপনা! তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মহাজোট সরকার আজ ধরাকে সরাজ্ঞান করছে। যেমন করেছিলো চারদলীয় জোট সরকার এবং তাদের পতনও হয়েছিলো। এ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠদের জন্যই এটা প্রাসঙ্গিক। তারা জেনে যাক- সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে সরকার গঠন করা যায়। মানি লোককে সিঁধেল চোর বলে, হাটের খালু বলে হেয় করা যায়, কিন্তু জনগনের মুখে হাসি ফোটানো যায় না!
চারপাশে সুনসান নিরবতা নেমে এসেছে। বাদশা শান্ত ও সমহিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন- তাহলে জনগনের মুখে হাসি ফোটানো যায় কিভাবে?

মসজিদ থেকে ভেসে আসছে ফজরের আযান। গল্প আজকের মত শেষ। আবার আগামী রাতে শুরু হবে নতুন গল্প। ভোরের স্নিগ্ধতায় তবুও বেগম বলে চলছে- জনগনের হাসি সে তো হেকিমী দাওয়াই। বিভিন্ন অনুপাতে মেশাতে হয় হাসির উপকরণ। বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সমাজে সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষাঙ্গনে সরকারী ছাত্র সংগঠন নিয়ন্ত্রণ, সেবাখাতে উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি...ইত্যাদি...ইত্যাদি.....এ সবকিছুর অনুপাতে কার্যকর শাসনব্যবস্থাই জনগনের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। তবে, জনগনের মুখে হাসি ফোটানো যায়, কিন্তু জনগনের হাসি কেনা যায় না।

সহস্র ও দুই রাত্রি

মহাজোট সরকারের প্রায় চার বছর চলে গেছে। চলে গেছে ১৩৮৯ দিন বা ১৩৮৯ রাত কিংবা চলে গেছে সহস্র রাত!
এ সহস্র রাতের ভীড়ে কিছু কিছু রাত ছিলো আরব্য রজনীর ভয়ঙ্কর রাত থেকেও ভয়ঙ্কর। কিছুদিন আগেই রামু সহ কয়েকটি বৌদ্ধপল্লীর সেই নৃশংস রাতের আধার এখনো কাটেনি, ক্ষত এখনো শুকায় নি। যে ক্ষত কলংকিত করেছে এদেশের সম্প্রীতির বন্ধন, সন্দেহ বাড়িয়েছে ধর্ম থেকে ধর্মে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানেরা। অপরাধবোধে ভুগছে মুসলিমেরা।
এমন আস্থাহীনতার মাঝেই এসেছে শারদীয় উৎসব, আসছে ঈদুল আযহা।
পাশাপাশি দুই ধর্মের প্রধান এ দুই ধর্মীয় উৎসব নির্বিঘ্নে উদযাপন নিশ্চই সম্প্রীতির বন্ধন জোড়ালো করবে। আস্থা তৈরী করবে একের সঙ্গে অপরের। 
তাই সহস্র রাত অতিক্রম করা সরকারকে নিষ্কন্টক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে উৎসবের এ দুই রজনীর। এখন এ দুই রাতই হতে পারে আরব্য রজনীর সেই সহস্র রাতের দুই রাত। যে দুই রাত সাম্প্রদায়িক কলংকে ঢেকে দিতে পারে সম্প্রীতির প্রলেপ।

বুধবার, ৩ অক্টোবর, ২০১২

সহিংস অক্টোবরে ছড়াক অহিংসার আলো


সময়কাল-অক্টোবর ২০০৬
সেবার ঈদ উৎসবটা অনেক আগেই শুরু হয়েছিলো। যে উৎসবে বাড়ি ফেরার তাড়া ছিলো না, টিকিট কাটার লাইন ছিলো না ! বাসে ট্রেনে অস্বাভাবিক ভিড়ও ছিলো না!
তবে ঈদের মতোই খুশি ছিলো, আনন্দ ছিলো, ছিলো বিশ্বকে কিছু দিতে পারার গর্ব। একজন বাংলাদেশীর (ডঃ ইউনুস) নোবেল জয় ঈদের ঠিক ১৩ দিন আগেই পুরো জাতিকে এনে দিয়েছিল সার্বজনীন এক আনন্দের উপলক্ষ।

কিন্তু শান্তিতে নোবেল জয় এদেশের মানুষকে আনন্দিত করলেও শান্তি এনে দিতে ব্যর্থ হয়েছিলো। তাইতো সেসময় রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত হয়েছিলো, রক্তাক্ত হয়েছিলো, রাজপথ। লগি বৈঠার আঘাতে সাপের মতো মরেছিলো মানুষ। মৃত মানুষের লাশের উপর হয়েছিলো উদ্দাম নৃত্য। যে দৃশ্য হার মানিয়েছিল কোন অ্যাকশন-থ্রিলার ছবিকেও। আমি জানিনা কোন ড্রামাক্রিটিক এই দৃশ্যকে কিভাবে নিতেন।

বিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ড্রামাক্রিটিক ছিলেন কেনেথ টাইনান। উপন্যাসিক হিসেবে সমাদৃত এবং নাট্য সমালোচক হিসাবে বিখ্যাত টাইনান কখনো নাটক লেখেননি! কেন নাটক লেখেননি এমন এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন-
একজন মানুষ তার জীবনে কলম দিয়ে যা কিছু লিখতে পারে তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হলো নাটক লেখা”


কঠিন বলেই হয়তো টাইনান নাটককে এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি বলে যাননি, আমাদের জীবনটাই একেকটা নাটক, আর সে নাটক এড়ানো সম্ভব নয়! সেটা ব্যক্তি জীবনেই হোক কিংবা জাতীয় জীবনে!

তাইতো ২৮ অক্টোবর’০৬ বাংলাদেশ এড়াতে পারেনি রাজপথের লগি বৈঠার নাটক। কোন মঞ্চ কিংবা টিভি নাটকের সাথে এ লগি বৈঠার নাটকের বৈসাদৃশ্য হলো-
টিভি নাটকে ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যে স্ট্যানম্যান ব্যবহার করা হয়। যেখানে রক্ত ঝরে না, ঝরে আলতা। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের সেই লগি বৈঠার নাটকের মানুষগুলো কোন স্ট্যানম্যান ছিলো না। লগি বৈঠার আঘাতে তাদের শরীর থেকে আলতা ঝরেনি বরং রক্তই ঝরেছিলো।

সময়কাল- অক্টোবর ২০১২
আশ্বিন মাসের শেষ সপ্তাহ চলছে। বাংলা প্রবাদে একটা কথা আছে- আশ্বিন, গা শিন শিন। কিন্তু বৈষয়িক উষ্ণতায়, আশ্বিনে পড়ে না গা শিন শিনে শীত, সব কিছুই যে এখন সুসময়ের বিপরীত। পৃথিবীটাই তো এখন উষ্ণ হয়ে উঠছে!

ধর্ম ও ধর্মীয় নেতাকে অবমাননা করে মুসলিমদের সংবেদনশীলতায় আঘাত করা আমেরিকার “ইনোসেন্স অফ মুসলিমস” মুভিকে কেন্দ্র করে তো উষ্ণতার পারদ শীর্ষে পৌঁছেছে, ইতোমধ্যেই আরব দেশগুলো সহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বিক্ষোভ হচ্ছে, আমেরিকার দূতাবাসে হামলা হচ্ছে….. লিবিয়াতে হামলায় নিহত হয়েছে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত সহ ৪ জন, মিশরে বিক্ষোভ সহিংসতা ছাড়িয়েছে, পাকিস্তানে বিক্ষোভ চলাকালীন সংঘর্ষে ১৯ জন নিহত হয়েছে। বাংলাদেশে একদিন হরতাল পালিত হয়েছে, যদিও এ হরতালের ছিল বিক্ষোভের জন্য পল্টন ময়দান নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে।

সুপরিকল্পিতভাবে বিদ্যেশ ছড়ানো নিষ্পাপ নামের কলুষিত প্রজেক্ট “ইনোসেন্স অফ মুসলিমস” এর উষ্ণ উত্তেজনা হয়তো আরো কিছুদিন থাকবে! মুসলিমরাও হয়তো ষড়যন্ত্রকারিদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে এ উত্তেজনার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলবে। যার উত্তাপ পুনঃ পুনঃ ছড়িয়ে পড়বে লিবিয়া থেকে মিশর, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ!

তবে ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশের মানুষ এ উত্তেজনার ফাঁদে পা দেয়নি। তাদের বিবেচনাবোধ সঠিক দিকেই ধাবিত হয়েছে, সেটা সচেতনভাবেই হোক কিংবা অসচেতনভাবে। ইতিমধ্যেই সরকার থেকে এ ছবিটির বিষয়ে নিন্দাসহ ছবিটি বাজেয়াপ্ত করতে আমেরিকার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ইউটিউব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে! সাধারণ মানুষ রাস্তায় মানববন্ধন এবং বিক্ষোভ সমাবেশ করলেও তা ছিলো শান্তিপূর্ণ যা কোন সহিংসতার রূপ নেয়নি। যা কিনা আমাকে স্বস্তি দিয়েছে! কিন্তু বেশ কিছুদিন থেকে একটি বিষয় আমার অস্বস্তির কারণ হচ্ছে…..

হলমার্ক কেলেংকারী, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি, শেয়ার বাজার কেলেংকারী, কুইক রেন্টালে দেশকে কুইক ডেস্ট্রয় নীতি, আইন শৃঙ্খলার ক্রমাবনতি এ সবকিছুতেই সরকার ব্যর্থতায় টালমাটাল! এর যে কোন এক ইস্যুতেই ঝড় উঠতে পারে চায়ের কাপে, উষ্ণ হতে পারে রাজপথ।

কিন্তু আশ্চর্য, এ বিষয়গুলো নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠলেও, তা রাজপথকে প্রভাবিত করেনি। রাজপথ এখন থমকে আছে! আর আমার উৎকন্ঠাটা এখানেই……. ঝড়ের পূর্বেও তো থমকে থাকে আকাশ। রাজপথের থমকে থাকা কি বড় কোন ঝড়ের পূর্বাভাস?

১৬ সেপ্টেম্বর, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ে স্বাক্ষর করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। এ রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্তি করা সহ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়।

১৯ সেপ্টেম্বর, প্রধানমন্ত্রী ও ১৪ দলীয় জোট নেত্রী শেখ হাসিনা সংসদে জানিয়েছেন-
“সংসদ রেখে নির্বাচন হবে না। ওয়েস্ট মিনিস্টার টাইপ অব গভর্নমেন্টে সরকারপ্রধান সম্ভাব্য তারিখ জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব দেবেন। তিনিই ঠিক করবেন সংসদ কবে ভেঙে দেবেন, কতজনের মন্ত্রিসভা থাকবে। তিনি যে নির্দেশ দেবেন, সে অনুযায়ী নির্বাচন হবে।”

২০ সেপ্টেম্বর, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও ১৮ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন-
“নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার না হলে বিএনপি কোন নির্বাচনে অংশ নেবে না, নির্বাচন হতেও দেবে না”।


এখন যে প্রশ্নগুলো সাধারণ মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে-
আগামী সংসদ নির্বাচন কি আদৌ হবে?
নির্বাচন হলে কার অধীনে হবে?
সরকার কি বিরোধী দলের দাবী মেনে তত্ত্বাবধায়ক ফিরিয়ে আনবে?
বিরোধী দল কি তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে?
যদি নির্বাচনের আগে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সমঝোতা না হয় তবে কি ২৮ অক্টোবরের ২০০৬ এর মতো রাজপথ আবারো সংঘাতের দিকে যাবে?

আমরা কি এগিয়ে যাচ্ছি, আরেকটি লগি বৈঠার তান্ডবের দিকে?
আমি ভাবছিলাম, ২০০৬ এর প্রশ্নগুলো কি নিদারুণভাবে ২০১২ তে করতে হচ্ছে! ২০০৬ এর অক্টোবর আর ২০১২ এর অক্টোবর একই প্লাটফর্মে রয়েছে। ৬ বছরের ব্যবধানে দেশটার অবস্থান একই স্থানে!

আশ্চর্য!

সেই ১৯৫৮ থেকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এই দেশে আন্দোলন চলছে। ৭১’এবং ৯০ এ সেই আন্দোলন চরমে পৌঁছেছিল। তারপর কিছুদিন বেসামরিক শাসনের পর আবার কিভাবে যেন ঘুরেফিরে সামরিক কিংবা অসাংবিধানিক সরকারই ফিরে আসছে। ফিরে আসছে অসাংবিধানিক সরকারের আশংকা।

সেই ৯০ থেকে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এই দেশে আন্দোলন চলছে। তারপরও প্রতিটি নির্বাচনেই চলছে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা। জনগনের ভোটের অধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এ খেলাই ঘুরেফিরে চলছে ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৬ এ, এমনকি ২০১২ তেও।

আসলে আলোচনা করার জন্য আমাদের চায়ের কাপ উষ্ণ হলেও জীবনটা বড় একঘেয়ে-

একটা রেকর্ডের মাঝেই যেন আটকে গেছে গ্রামোফোনের পিন! বারবার একই সুরে একই কথায় রেকর্ডটা বাজছে। গণতন্ত্রের জন্য, প্রভাবমুক্ত সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবীতে চিৎকার করতে করতেই কি জীবনটা শেষ হয়ে যাবে? দেশটা কি একটুও এগোবে না? আমরা কি এগিয়ে যাবো আরেকটি লগি বৈঠার তান্ডবের দিকে? রাজপথের নৃশংস হত্যাকান্ডের দিকে? আরেকটি ওয়ান/ইলেভেনের দিকে?

এ সকল অস্থির ভাবনার মাঝে আমি দেখছিলাম, আজকের দিনপঞ্চি-
আজ ২রা অক্টোবর, আন্তর্জাতিক সহিংসতা প্রতিরোধ দিবস বা আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস।

অহিংসার আলোয় ভালোবাসার মন্ত্র ছড়িয়েছিলেন যে মহাত্মা
১৮৬৯ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অখন্ড- ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনীতিবিদ এবং অখন্ড- ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তি মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী।

যিনি ছিলেন সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। যে আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো অহিংস মতবাদ বা দর্শনের ওপর এবং এটি ছিলো ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম চালিকাশক্তি। সারা বিশ্বের মানুষের স্বাধীনতা এবং অধিকার পাওনায় আন্দোলনের অন্যতম অনুপ্রেরণা।

মহান এ নেতার স্মরণে ভারত সরকার দিবসটিকে গান্ধী জয়ন্তী হিসাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করলেও ২০০৭ সালে জাতিসংঘ দিবসটিকে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসাবে পালনের ঘোষণা দেয়।

এ অক্টোবরেই জন্ম নিয়ে মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী অহিংসার যে আলো ছড়িয়েছেন, সে আলো তাকে করেছিলো মহাত্মা আর বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে দিয়েছিলো ঘৃনার বিপরিতে ভালোবাসার মন্ত্র!!!

আমি ভাবছিলাম, ২০০৬ এর সহিংস অক্টোবর কি ২০১২ তে অহিংস রূপ নেবে? রাজপথে সহিংসতার বিরুদ্ধে, রক্ত ও জীবন নাশের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে দেবে অহিংসার আলো !?

যে আলোয় আন্তর্জাতিক সহিংসতা প্রতিরোধ দিবসেই সুষ্ঠু নির্বাচন আর গণতন্ত্র সুরক্ষার আন্দোলনে অহিংস হয়ে উঠবে দীর্ঘকাল রাজনৈতিক সহিংসতার আক্রান্ত এ জাতি।

পুনশ্চ: লেখাটি লেখার পরের দিন, রাজনৈতিক সহিংসতার আক্রান্ত জাতিটি হঠাৎ করে ধর্মীয় সহিংসতায় আক্রান্ত হয়েছে!!! কক্সবাজারের রামু, টেকনাফ, উখিয়া, ও চট্রগ্রামের পটিয়ায় ধর্মের নামে অধর্মের পাশবিক প্রকাশ ঘটিয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু অংশ……লজ্জা….লজ্জা

মন্দির কিম্বা মূর্তি নয়, ভেঙ্গেছে অনুভূতিশীল মানুষের হৃদয়
আমি মনে পড়ছে মুক্তিযুদ্ধের সময় আঁকা নিতুন কুন্ডুর সেই সাড়া জাগানো পোস্টারের কথা ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি’,। ভাবছিলাম- ‘আমরা সবাই বাঙালি থেকে কি করে এতো ধার্মিক হয়ে উঠলাম? হিংসার আগুনে কিভাবে পোড়ালাম- ভাতৃত্বের বন্ধন, মানবিকতা, উদারতা, বিশ্বাস, পোড়ালাম বাড়ি, দোকান, মন্দির…………
বুদ্ধের শরির, আর গান্ধির বিবেক পুড়িয়ে সব ভস্স করে দিয়েছি, জানিনা এ পোড়া ছাই থেকে জেগে উঠবে কিনা বিবেকের ফিনিক্স পাখি!!! শুধু জানি, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি’,। আমরাই ছড়িয়ে দেব- হিংসার বিপরিতে ভালোবাসার মন্ত্র।