মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৪

শতেক দূরে ফোটা করবী

গনতন্ত্র যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে...
এপাশ হলেও ব্যাথা, ওপাশ হলে অসহ্য যন্ত্রনা। সৈরাতন্ত্রের হাঁড় মড়মড়ে রোগে ধরেছে গনতন্ত্রকে!
কত ওঝা এলো, কত হেকিম গেলো, কিছুতেই কিছু হয় না! পাট কাঠি ভাঙ্গার শব্দে ভাঙ্গে হাঁড়। সে শব্দ বিলীন হয় যন্ত্রনার আর্তনাদে...
ভাঙ্গা হাড়ে, ভাঙ্গা স্বরে- শেফা চায় গনতন্ত্র। বিনিময়ে ফিরিয়ে দেবেন ভোটের অধিকার। আর বাকস্বাধীনতা হরন হবে না, বিরোধীর বুকে চলবেনা গুলি..গনতন্ত্র শুধু শেফা চায়। যন্ত্রনা থেকে মুক্তি চায়...
রাজ হেকিম নাড়ি টিপে কোন আশা পান না! প্রচারমন্ত্রী অবশ্য ঢোল পিটিয়ে চোঙ্গায় মুখদিয়ে ঘোষনা করেন- গনতন্ত্র ভালো আছে, সুস্থ্য আছে, গনতন্ত্রের মানসকন্যার হাতে দিব্যি হাসছে, খেলছে...
প্রচার যন্ত্রের এমন সুপ্রচারে ফিরে যায় আসস্ত পূজারী জনগন। গনতন্ত্র চিৎকার করে ডেকে ফেরে- ফিরে আসো নূর হোসেন, ফিরে আসো মিলন...
কিন্তু হাঁড় মড়মড়র শব্দে হারিয়ে যায় এ আহবান! এখন গনতন্ত্রের কথা শোনার কেউ নেই, গনতন্ত্রের কথা বলার কেউ নেই...

অবশেষে গনতন্ত্রের ডাকে একজন সাড়া দিলেন, এক দেবদূত এলেন হেকিম সেজে! নিস্তেজ গনতন্ত্র যখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে....
দেবদূতে স্পর্শে ক্ষনিক স্বস্তি পায় গনতন্ত্র। বাঁচার তীব্র আকুতিতে জানতে চায় তার সুস্হ্যতার দাওয়াই।
দেবদূতের মনে তখন অন্যকিছু! মুচকি হেসে সে জানায়- দাওয়াই একটা আছে, তবে সে বড় কঠিন দাওয়াই!
মুমূর্ষ গনতন্ত্রের চোখ চকচক করে ওঠে- কি? পৃথিবী তন্নতন্ন করে ১০৮ টি নীলপদ্ম আনতে হবে?
দেবদূতঃ না, সে আরো কঠিন দাওয়াই।
বাঁচার আকুতিতে গনতন্ত্র আরো দৃঢ় হয়ে ওঠে- তবে কয়েক তাল মাটির নিচ থেকে খুঁজে আনতে হবে আমার প্রান ভ্রমরা?
দেবদূতঃ না, সে আরো কঠিন চিজ।
অধৈর্য হয়ে ওঠে গনতন্ত্র- তবে কি সে দাওয়াই?
দেবদূতঃ বর্তমান সংসদের সরকার বিরোধী সমালোচনা! অন্তত একজনের মুখে সমালোচনা শুনতে হবে। শুনলেই তুমি সুস্থ্য হয়ে যাবে..
একথা শুনে হেসে ওঠে গনতন্ত্র, ভুলে যায় হাঁড় ভাঙ্গা যন্ত্রনা, অট্ট হাসিতে চারপাশ কাঁপিয়ে বলে- এ আর এমনকি? শেয়ার বাজারের লুটেরাদের, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসকারীদের, নির্বাচনকে খেলো করে ভোটারদের দ্বারা প্রত্যাক্ষাতদের সমালোচনা? এখনি শুনে নিচ্ছি, এখনি সুস্থ্য হয়ে উঠছি...
দেবদূত মুচকি হেসে বলে- ধীরে বৎস, ধীরে। এতটা সহজ নয়! দেখ চেষ্টা করে পারো কিনা! এখন আমার যাবার সময় হয়েছে, কাল এসময় আবার আসবো..
'কাল এসে আমাকে সুস্থ্যই দেখবেন' বলে দেবদূতকে বিদায় জানায় গনতন্ত্র। দেবদূত বিদায় নেয় মুচকি হেসে...

অনেকদিন পর, সুস্থ্যতার সম্ভবনায় উঠে দাঁড়ায় গনতন্ত্র। তার এখন অনেক কাজ, সংগ্রহ করতে হবে সুস্থ্যতার দাওয়াই! বর্তমান সংসদের সরকার বিরোধী অন্তত একটি সমালোচনা!
যদিও এবার নির্বাচন হয়েছে একতরফা, তবুও সরকারের বাহিরের সাংসদ তো আছে, আছে বিরোধীদলও। সমালোচনার দাওয়াই খুব সহজেই পাওয়া যাবে..
গনতন্ত্র চোখ বুলিয়ে নিলো, দশম সংসদের দলভিত্তিক আসন সংখ্যায়-আওয়ামী লীগ ২৩৩, জাপা ৩৪, স্বতন্ত্র ১৫, ওয়ার্কার্স পার্টি ৬, জাসদ (ইনু) ৫, তরীকত ফেডারেশন ২, জেপি ১ ও বিএনএফ ১টি আসন।
এর মধ্যে সমালোচনা লিস্ট থেকে আওয়ামীলীগের ২৩৩ জন বাদ, তাদের কাছে তাদের সমালোচনা আশা করাও দুরাশা! গনতন্ত্রকে যেতে হবে অবশিষ্ট ৬৬ জনের কাছে। যেতে হবে- সংসদীয় গনতন্ত্রের সৌন্দর্য খুঁজতে, গনতন্ত্রের সৌন্দর্য্য আর সুস্থ্যতা যে সেখানেই...

প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টির কাছে প্রথম ধাক্কা খায় গনতন্ত্র! সরকারের সমালোচনা করবে কি? তারা তো এখন সরকারের অনুগ্রহে প্রধান বিরোধীদল হবার গরবে গরবিনী। একই সাথে বিয়ের ছেলে আর মেয়ের বাপ হবার হিস্যায়, একই সাথে প্রধান বিরোধীদল আর মন্ত্রীসভার ভাঁড় হতে তারা ব্যস্ত, তারা ব্যস্ত নিজেদের মন্ত্রী বানানোর আর মন্ত্রী বাড়ানোর দরকষাকষিতে। দেশ গোল্লায় যাক, মন্ত্রীর সংখ্যা বাড়লেই হলো! এখানে টান পড়লেই তারা সমালোচনা করবে, সে সময় এখনো ঢের বাকি! চার মন্ত্রীর আম আর এক বিশেষ দূত তারা পেয়েছে, এমন আম-দুধ সময়, সমালোচনায় কেইবা নষ্ট করবে?

তারপর গনতন্ত্রকে একে একে ধাক্কা খাবার পালা! ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু) সবাই এখন একই লাওয়ের মাঝি! কোথায় আজ সিরাজ শিকদার? সত্যি, আজ কোথাও নেই....!!
তরীকত ফেডারেশন, জেপি, বিএনএফ এমনকি সতন্ত্র ১৫ জন, তারা সমালোচনা করবে কি? তারা অনুগ্রহ আর অনুকূলের কৃতজ্ঞতায় ব্যস্ত! অবিশ্বাসী হয়ে তারা সরকারের কোন অবদানকে অস্বীকার করবে?
হঠাৎ গনতন্ত্রের যন্ত্রনা বেড়ে যায়। হাড়গুলো মড়মড় করে ওঠে। দীর্ঘ সংগ্রামে অর্জিত গনতন্ত্র, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে! লুটিয়ে পড়ে বাংলাদেশও....

পরের দিন দেবদূত যখন এলেন, গনতন্ত্র তখন নিস্তর-নিথর। হাঁড় মড়মড়ে আওয়াজ নেই, নেই জীবনের চিন্হও.....
ইতিমধ্যেই কবর খোঁড়া হয়েছে, এপিটাফও লেখা হয়েছে! কিন্তু বাধ সাধে এক ছায়ামূর্তি....গনতন্ত্রকে সে কবর দিতে দেবে না!!!
দেবদূতঃ কে তুমি?
ছায়ামূর্তিঃ আমি নূর হোসেন।
দেবদূতঃ কোন নূর হোসেন?
ছায়ামূর্তিঃ আমি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জীবন দেয়া 'নূর হোসেন'। আমি সেই নূর হোসেন, যে গনতন্ত্রকে সেসময় করব দিতে দেয় নি।
দেবদূতঃ ভুল করেছ, রক্তের বৃথাই অপচয় করেছ। যেখানে অধর্মের আবাদ হয়, ধর্ম সেখানে আগাছা! গনতন্ত্র এখন সেচ্ছাচারিতার আবাদে আগাছা হয়ে গেছে এবং সেটা উপড়ে ফেলা হয়েছে! সেচ্ছাচারিতায় উপরে ফেলা এ আগাছাকে কবর দিতে দাও। জীবনের ওপারেই মিলিত হও, তোমার কাংক্ষিত গনতন্ত্রের সাথে...
ছায়ামূর্তিঃ মিলবো বলে তো জীবন দেইনি? বরং এ দেশের ভবিষৎ'তের সাথে গনতন্ত্রকে মেলাবো বলে জীবন দিয়েছি।
আর গনতন্ত্র মৃত নয় যে একে কবর দিতে হবে! গনতন্ত্র মরনহীন..
দেবদূতঃ হাসালে তুমি মৃতআত্বা! জীবনের আইন সম্পর্কে তোমার চিন্তা শিশু সূলভ। তুমি কি বলছো- এ প্রানহীন গনতন্ত্র মৃত নয়?
ছায়ামূর্তিঃ হ্যাঁ, বলছি। এটা গনতন্ত্রের মৃত্যু নয় বরং অভিমান! গনতন্ত্র শুধু আইন নয় যে বেআইনে এর মৃত্যু ঘটবে! গনতন্ত্র একি সাথে, আইন এবং অনুভূতি। শুধু আইন ও অঘোষিত বেআইনে এর মৃত্যু ঘটবে না! যতক্ষন সাধারন মানুষের মনে গনতন্ত্রের অনুভূতি থাকবে, ততক্ষন গনতন্ত্রও থাকবে। যখন মানুষ চাইবে, যখন ডাকবে, গনতন্ত্র তখনই জেগে উঠবে...
দেবদূতঃ নূর হোসেন, তুমি এখন মৃত! নূর হোসেনেরাও এখন মৃত। মানুষ আর গনতন্ত্রকে চায় না! গনতন্ত্রকে আর ডাকে না। সরে যাও গনতন্ত্রকে এখন কবর দিতে দাও, আমাকে আমার কাজ করতে দাও..
ছায়ামূর্তিঃ তার আগে আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দাও- কোনটি বেশী পবিত্র? তোমার এই কাজ নাকি গনতন্ত্রের জন্য দেয়া আমার বুকের রক্ত?
দেবদূতঃ অবশ্যই শহীদের রক্ত। সেটা সব কিছুর চেয়ে পবিত্র...
ছায়ামূর্তিঃ শহীদের রক্তই যদি শ্রেষ্ট হয়, তবে যার জন্য এ শাহাদত সেটা কি শ্রেষ্ট নয়? এ আদর্শের কি কবর হতে পারে?
বিব্রত দেবদূত থমকে যায়! চাপা স্বরে বলে- তাহলে কি চাও তুমি?
ছায়ামূর্তিঃ অভিমানী গনতন্ত্রকে কবর নয় বরং করবী ফুল করে দাও, আমার রক্তে রাঙ্গা হয়ে সেটা ফুটে থাক রক্ত করবী হয়ে! যেমন রুপকথার সাতভাই ফুটেছিলো সাতটি চম্পা ফুল হয়ে।
সেদিন আর বেশী দূরে নয়, যেদিন একটি পারুল বোনের সাথে যখন সবাই ডাকবে, তখন সাতভাইয়ের মতো গনতন্ত্রও জাগবে।
যখন, বাংলা মায়ের ব্যথায় গাছের পাতা ঝরে
কাঁদবে বনের পাখি কুহু কুহু স্বরে।
একটি পারুল বোন থাকবেনা একা ঘরে
করবী মিলবে রাজপথে, রক্তের অক্ষরে
সেদিন রাষ্ট্রযন্ত্রের বন্দুক ফুড়ে
গনতন্ত্রের জীবন পাবার দিন আসবে ফিরে।।
সুরের মায়া কাটিয়ে মুগ্ধ দেবদূত বললেন- তথাস্তু।

গনতন্ত্র এখন ফুটে থাকা রক্ত করবী ফুল। সৈরাতন্ত্রে পূজা দেবেনা বলে উঠেছে শতেক দূর! ভালোবেসে এখন গনতন্ত্রকে ডাকতে হবে, যে ভালোবসায় নূর হোসেন পথে নেমেছিলো, যে ভালোবাসায় বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলো