শুক্রবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৪

পথনাটকের সঞ্জিবনী রত্ন

বছর পাচেক আগের কথা।
বিলচলন ইউনিয়নের বোঁথড় গ্রামের এক উঠানে, জমায়েত হয়েছিলো অসংখ্য লোক!
উঠোনের একপাশে বর্গাকৃতির শেফে করা হয়েছিলো অস্থায়ী প্রদর্শনী মঞ্চ। কিছুক্ষনের মধ্যেই যেখানে হবে নাট্য প্রদর্শনী।
সুতলি দিয়ে তৈরী করা মঞ্চের বিভাজনের সামনে বসে ছিলো শিশুরা, যাদের পেছনে দাড়িয়ে ছিলো মাঝ বয়সী এবং বয়স্করা। একপাশে ছিলো মেয়ে এবং মহিলারা।
বোঁথড় গ্রামে এটা একটি নিয়মিত ঘটনা। তবে সে সন্ধ্যার বিশেষ দিকটি ছিলো- সেদিন দর্শকসারিতে ছিলেন এক বিশেষ অতিথি। সৈয়দ জামিল আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক। বাংলাদেশের নাট্য গবেষনায় যিনি ছুটে বেড়াচ্ছিলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, মনি মুক্তার খোঁজে।
যে মুক্তা প্রাপ্তির প্রচেষ্টাতেই তিনি হয়েছিলেন উঠোন দর্শক, এবং দেখছিলেন- আসাদুজজামান দুলাল রচিত এবং নির্দেশিত নাটক।
একসময় নাটক শেষ হলো। করতালিতে ফেটে পড়লো দর্শক। দর্শকের মতো জামিল আহমেদও করতালি দিলেন এবং করদুটি প্রসারিত করে জড়িয়ে ধরলেন আসাদুজ্জামান দুলালকে।
আপত দৃষ্টিতে যেটি ছিলো আবেগঘন তবে সাধারন একটি ঘটনা।
তবে এর অসাধারন দিকটি বুঝতে আমার সময় লেগেছিলো প্রায় ১৮ ঘন্টা! সম্ভবত অসাধারনত্ব সব সময়ই সময়ের দাবী রাখে...(আমি জানি না, সে সময়ের দাবীতেই কিনা, এটা জানাতে আমারও সময় লাগলো প্রায় ৫ বছর!!!)
পরেরদিন দুপুরে ভাঙ্গুড়ায় স্বদেশ কাকুর বাসায় সৈয়দ জামিল আহমেদের সঙ্গে কিছুসময় আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিলো। আমি তাকে দুটি প্রশ্ন করেছিলাম-
প্রশ্ন এক.- একজন নাট্য গবেষক হিসাবে চাটমোহরের নাটক সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
এবং প্রশ্ন দুই.- বাংলাদেশের মুক্ত নাটকের ভবিষৎ কি?
আলাদা ভাবে করা এ দুটি প্রশ্নের আলাদা ভাবে দেয়া উত্তরে উনার অভিব্যাক্তি ছিলো একই। যে অভিব্যাক্তি এবং উত্তর আমাকে গর্বিত করেছিলো।
উত্তর এক.- চাটমোহরের নাটক এককথায় অসাধারন। শুধু নাট্য মানেই নয় এর উঠান শো এবং সাইকেল শো হতে পারে মুক্ত নাটকের অনুকরনীয় ধারা।
উত্তর দুই.- শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা পৃথিবীতেই বানিজ্যের কাছে মুক্ত নাটক, মঞ্চ নাটক মার খেয়ে যাচ্ছে। এর ভবিষৎ নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয়, তবে যতদিন আসাদুজ্জামান দুলালের মত মানুষেরা আছেন, যতদিন আসাদুজ্জামান দুলালেরা নিজেকে নিঃস্ব করে বনের মোষ তাড়াবেন ততদিন মুক্ত নাটক স্বমহিমায় টিকে থাকবে।

সেদিন সৈয়দ জামিল আহমেদের সাথে আরো কিছু বিষয়ে কথা হলেও, উনার কাছ থেকে জানা হয়নি- তিনি চাটমোহরের রসমালাই খেয়েছেন কিনা? প্রত্ন নিদর্শন শাহী মসজিদ দেখেছেন কিনা? বৃন্দাবন দাসের নাটক তার কেমন লাগে?
জানাটা প্রয়োজনীয়ও ছিলো না! দুধ আর সততার যোগানের সাথে ঘোষালী দক্ষতায় এমন রসমালাই অন্যকোথাও হতে পারে! ৪০০ বছরের প্রত্ন নিদর্শন আরো ৪০০ বছর পরে এই চাটমোহরেই নুন্যতম ২০টা থাকতে পারে! মিডিয়ার জনপ্রিয় ধারায় চাটমোহরকে রিপ্রেজেন্ট করার জন্য আগামী ৫০ বছরে জনা দশেক বৃন্দাবন দাস তৈরী হতে পারে! কিন্তু আসাদুজ্জামান দুলাল একজনই। আরেকটি পেতে হলে, এ চলনবিলে আরো কতটা জল গড়াতে হবে? কতবার চলনবিল মন্থন করে, কত বছরে পাওয়া যাবে এমন একটি রত্ন, তা জানেনা কেউ! জানে না নাট্যরত্ন খুঁজে ফেরা জামিল আহমেদের মতো নাট্য স্কলারও.....

লেখাটি এখানেই শেষ হতে পারতো! তবে প্রাসংগিক ভাবেই আমি আরেকটু যোগ করতে চাই। আমার বাড়ি বোঁথড় স্কুলের পেছনে হওয়ায়, অসংখ্য রাতে বাড়ি ফেরার সময় খেয়াল করেছি, স্কুল মাঠের একপাশে একাগ্রচিত্তে অনুশীলন করছে নাটকের মানুষগুলো। যারা সবাই বিভিন্ন পেশাজীবি। সারাদিনের পেশাগত ক্লান্তি নিয়েই সন্ধ্যার পর যারা চলে আসে নাট্য ঝালাইয়ে। অথচ, তার ঠিক পাশেই গোটা বিশেক চা-দোকানে তখন টিভিতে চলছে ছবি, গান, নাটক। কোনটাতে চলছে কেরামের টুং টাং...
আমি মুগ্ধ হয়ে ভাবি- এ বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষগুলো, সারাদিনের পরিশ্রম শেষে সন্ধ্যার পর কোন চা-দোকানে ছবি আর গানে বিনোদন খুঁতে পারতো! আনন্দ পেতে পারতো একের পর এক গুটি কেরাম বোর্ডের পকেটে ফেলে!
কিন্তু তারা সেটা না করে, বেছে নিয়েছে শিল্পের সেই কঠিনতম পথ- যেখানে কোন প্রাপ্তি নেই(অর্থযোগ অর্থে)! সামাজিক মর্যাদা নেই!(পত্রিকায় তাদের ছবি ছাপা হবে না, কোন সামাজিক সংগঠন তাদের পুরুষ্কারও দেবে না, কেউ তাদের নিয়ে গর্বও করবে না!!)
আবার ভাবি, জাগতিক এসব প্রাপ্তিতে এ সব অসাধারন মানুষ গুলোর কিছুই যায় আসে না। এবং যায় আসে না বলেই, ক্লান্তি পেরিয়ে তাদের নিরলস শ্রম এবং নিজেদের নিংড়ে দিয়ে বনের মোষ তাড়ানোতেই এখনো চাটমোহরে পথনাটক টিকে আছে।