মঙ্গলবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১১

ব্যক্তিত্বহীন সাংবাদিকতার প্রয়োজনীয় শিক্ষা!!!

জারো্লাভ সিফার্ট-এর জন্ম হয়েছিল ১৯০১-এ  একটি খেটে খাওয়া পরিবারে, চেক প্রজাতন্ত্রের জিজকভ শহরের উপকণ্ঠে। পরিবার ও শহরের দারিদ্র্য তাকে কমিউনিস্ট হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি ১৯২১-এ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কিন্তু তাদের বলশেভিক চিন্তাধারার সমালোচনা তিনি করতে থাকেন এবং আট বছর পরে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন।
তিনি একাধিক কমিউনিস্ট পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের সম্পাদনা করতেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কমিউনিস্ট সরকারের কঠিন সমালোচনা করায় তিনি প্রভাবশালীদের বিরাগভাজন হন। সিফার্ট সাংবাদিকতায় লেগে থাকেন। সরকারের প্রতিবন্ধকতার মুখে সিফার্ট ১৯৪৯-এ এক পর্যায়ে সাংবাদিকতাও ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
তিনি তার একক সংগ্রাম চালিয়ে যান। তিনি বহু রকমের লেখায়, বিশেষত কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করেন। কিন্তু কমিউনিস্ট সরকার তার লেখালেখির ওপর কড়া নজর রাখে এবং তার অনেক লেখা অপ্রকাশিত থেকে যায়। ১৯৭৭-তে চার্টার ৭৭ মানব অধিকার ম্যানিফেস্টোতে সই দেয়ার জন্য তিনি ব্ল্যাক লিস্টেড হন।   তার কবিতা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৮৪-তে তিনি সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পান।  এবং এখন পর্যন্ত তিনিই একমাত্র চেক যিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে সিফার্ট-এর শিক্ষাগত যোগ্যতা কি ছিলো?
এ বিষয়ে উইকিপিডিয়ায় কোন তথ্য না থাকলেও নোবেল প্রাইজের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে সিফার্ট এর বায়োগ্রাফিতে লেখা আছে তিনি সেকেন্ডারি স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন না বা কোন সার্ভিস কমিশনের ক্যাডারও  ছিলেন না। তবে কি সিফার্ট ভালো লেখক বা ভালো সাংবাদিক, সর্বপরি নোবেল পাবার যোগ্য ছিলেন না???
 হয়তো সিফার্টের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতে পারে কিন্তু চেক জনগণের কাছে সিফার্ট সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। চেক জনগণ মনে করে তিনি ছিলেন একজন সাহসী ও প্রতিবাদী লেখক যিনি তার নীতির সঙ্গে আপস করেননি।  জারো্লাভ সিফার্ট ভাগ্যবান, তিনি বাংলাদেশে চাটমোহরের বড়াল তীরে জন্ম নেননি! তাহলে হয়তো তার যোগ্যতা হতো প্রশ্নবিদ্ধ এবং তিনি হতেন বিতর্কিত!
এই মুহূর্তে  আমি পড়ছিলাম, ৭ এপ্রিল দৈনিক চলনবিল'এর একটি রিপোর্ট। "ইউএনও'র সাংবাদিক জ্ঞান" শিরোনামে রিপোর্টে এসেছে- চাটমোহরের ইউএনও ফিরোজ শাহ্ স্থানীয় দুজন সাংবাদিকের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরন করেছেন, সাংবাদিকদের অশিক্ষিত বলেছেন এবং তাদের বিসিএস উত্তির্ন হয়ে আসতে বলেছেন!!!
আমি ভাবছিলাম, উচ্চ শিক্ষিত ইউএনও তার বোধকে কতটা নিম্ন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন! কারন, লেখক কিম্বা সাংবাদিকের সৃষ্টিশীল পেশার  জন্য ভালো পড়াশোনা দরকার, পড়াশোনার ওপর ডিগ্রি নয়!(আমি বলছি না যে উচ্চ শিক্ষার দরকার নেই, আমার মতে, এ বিষয়ে উপদেশ হতে পারে, কটাক্ষ নয়)। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে গনযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা নামে বিভাগ চালু আছে এবং এর ওপর পড়ালেখা করতে হয় তবুও বলবো সৃষ্টিশীল কাজে পড়ালেখা করে বোদ্ধা হওয়া যায় সৃষ্টিশীল মানুষ হওয়া যায়না, এ জন্য প্রয়োজন অনুশীলনের।  আর চাটমোহরের ইউএনও'র মতো বোধ যদি সিফার্টের থাকতো তাহলে হয়তো তিনি লেখালেখি ছেড়ে তার বাবার মতো কারখানার শ্রমিক হতো। এ বোধ যদি দুখুমিয়া'র থাকতো তাহলে হয়তো সে নজরুল না হয়ে আজীবন রুটির দোকানে কাজ করতো।
আমি আশা করছি, ইউএনও মি. শাহ্ এ বিষয়ে সিফার্টের জীবন থেকে শিক্ষা নেবেন এবং তার ভুল বুঝতে পারবেন।
এখন প্রশ্ন হলো, এ থেকে চাটমোহরের সাংবাদিকেরা কি শিখবেন???
এ  প্রশ্নর উত্তর দিতে গেলে স্বভাবতই যে প্রশ্ন দুটি আসবে-
এক, ইউএনও'র বক্তব্য কি সাংবাদিকদের অপমানবোধ জাগ্রত করেছে?
উত্তর-না! কারন এ বক্তব্যের পরও চাটমোহরের সাংবাদিকেরা ঐক্যমতে পৌছাতে পারেনি। তারা মিলিত ভাবে প্রতিবাদ করেনি! সাংবাদিকদের একদল একটি রিপোর্ট, একটি ফলোআপ ও একটি মিটিং করলেও তা সম্ভবত অপমানবোধ থেকে নয় বরং অহংবোধ সমস্যা থেকে তাই তারা অল্পতে মিইয়ে গেছে বা থেমে গেছে। আর থামার মাধ্যমেই তারা ইউএনও'র বক্তব্য মেনে নিয়েছে, প্রমান হয়েছে ইউএনও সত্য বলেছেন!!!
দুই, ইউএনও যদি সত্য না বলে থাকেন এবং তার বক্তব্য যদি অপমানজনক হয়ে থাকে তাহলে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হলো না কেন?
উত্তর- সাংবাদিকদের দূর্বল ব্যক্তিত্ব।
তাই এ ঘটনা  থেকে চাটমোহরের সাংবাদিকেরা শিখতে পারে, ব্যক্তিত্ববান হতে এবং সিফার্টের মতো সাহসী, প্রতিবাদী ও আপসহীন হতে।-২৪এপ্রিল'১১।

রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১১

স্রষ্টা সবার জন্য নয়!!!

সকালে পত্রিকা কিনে সবে মাত্র চা'র দোকানে বসেছি। কালো রং, উসকো খুসকো চুল, বিশেষত্বহীন টোকাই চেহারার একটি ছেলে, কতই আর বয়স? নয়-দশ। এক হাতে রুটি অন্য হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে করুন চেহারায় বললো- পাঁচটা ট্যাকা দেন।
বিরক্তি নিয়ে বললাম-টাকা দিয়ে কি করবি?
চা দিয়া রুটি খামু, ছেলেটির তাৎক্ষনিক জবাব।
করুনা প্রত্যাশি একটি ছেলের স্পষ্ট জবাবে বিরক্ত আমি ততোক্ষনে পত্রিকায় মনোযোগ দিয়েছি। কিছুক্ষন পর খেয়াল করে দেখি, ছেলেটি তখনো দাড়িয়ে, আনমনে রুটির ফোলা অংশ ছিড়ে খাচ্ছে।
আমি দোকানদারকে ছেলেটির জন্য চা দিতে বলে পত্রিকায় চোখ বোলাচ্ছি, প্রথম আলো'র সারা বিশ্ব পাতায় পড়ছিলাম "পাঁচ বছরের তারকা সুরি"। স্বনামখ্যাত হলিউড তারকা টম ক্রুজ ও কেটি হোমসের মেয়ে সুরি। গায়ের উজ্জল রং, ভিন্ন ধাঁচের বাদামি চুল, সবুজ চোখ ও মিষ্টি চেহারায় অন্য রকম বিশেষত্ব এনে দেয়া সুরি, নিজ মহিমাতেই শিশু তারকা। যার প্রত্যেকটি পোষাকের দাম দুই হাজার ডলার, যার ওয়ারড্রোবেই আছে ২৫ লাখ ডলারের পোশাক!
মনটা হঠাৎ খাখা করে ওঠে.....চোখ তুলে তাকাই- টোকাই ছেলেটি তখন চায়ে রুটি ভিজিয়ে খেতে ব্যস্ত।
আমি বলি- স্কুলে যাস?
কোন জবাব আসে না!
হয়তো শুনতো শুনতে পায়নি, হয়তো শুনলেও জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করে নি! টোকইয়ের আবার স্কুল!!!
আমি ভাবছিলাম. স্রষ্টা সতিৎ দয়াময়! তার দয়ায় এই ছেলেটির স্কুল ভাগ্য নেই!
এই ছেলেটি যদি স্কুলে যেতো, তাহলে হয়তো হিসেব কষে বের করে ফেলতো, ২৫ লাখ ডলার সমান কত টাকা! ছেলেটি তখন বুঝে যেতো স্রষ্টা সবার জন্য নয়! স্রষ্টা  থাকেন কোনো ভদ্র পল্লিতে, সুরিদের ওয়ারড্রোবে, টোকাইয়ের চায়ের কাপে নয়!
আমার চোখ ছলছল করে ওঠে.....আমি পত্রিকায় মুখ ঢাকি। লজ্জায়....না না ভয়ে! ছেলেটি যদি আমার চোখের ভাষা বুঝে ফেলে।

বুধবার, ২০ এপ্রিল, ২০১১

মূল্যবোধের বনসাই, ভগ্ন মহিলা কলেজ!!!

এই উপমহাদেশে "বৃদ্ধস্য তরুনি ভার্যা" বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। সাধারনত বৃদ্ধরা তরুনী প্রেমিকা কিম্বা তরুনী স্ত্রীর সঙ্গ পছন্দ করেন। এই পছন্দ করাটা নৈতিক মূল্যবোধে চাপা পড়তে পারে আবার অনৈতিক বাসনার ভীমরতিতে পরিনত হতে পারে। আর যে ভীমরতিকে বলা যেতে পারে শুদ্ধ চিন্তার প্রহসন!
হয়তো মাইকেল মধুসূদন দত্ত এ ভীমরতি কাছ থেকে দেখেছিলেন, ব্যথিত হয়েছিলেন এবং ভগ্ন হৃদয় নিয়ে ১৮৬০ সালে লিখেছিলেন, সার্থক প্রহসন "ভগ্ন শিবমন্দির"। যদিও প্রকাশকালে তিনি নাম পরিবর্তন করে রাখেন- 'বুড়ো শালিখের ঘারে রোঁ'। সে বছরের প্রথমার্ধে তিনি লিখেছিলেন প্রহসন "একেই কি বলে সভ্যতা"?
প্রায় একই সময়ে লেখা তার এ দুটি প্রহসনে ছিলো বিপরীত চিত্র! 'একেই কি বলে সভ্যতা' প্রহসনটি ছিলো নব্য শিক্ষিত নাগরিক যুবকদের নিয়ে আর 'বুড়ো শালিখের ঘারে রোঁ' প্রহসনটি ঐ সমাজের বিপরিত পৃষ্ঠার অশিক্ষিত অথচ প্রভাবশালীর বাস্তব গল্প। যেখানে ধর্মে আস্হাশীল বৃদ্ধ ভক্ত, ভক্তি মালা হাতে নিয়ে দান দক্ষিনা দেয় না কিন্তু নারী দেহে লোলুপ হয়ে খাজনা মাফ করে দেয়। জাত-ধর্মের কথা বলে উপদেশ দেয়, আবার সেই কপট, নিষিদ্ধ আকাংক্ষায় মুসলিম নারির সান্নিধ্য কামনা করে।
এখন প্রশ্ন হলো, অশিক্ষিত বৃদ্ধ ভক্তের মতো অশিক্ষিতরাই কি বয়সের ভীমরতিতে আক্রান্ত হয় নাকি শিক্ষিত শালিখের ঘারেও রোঁ উঠতে পারে?
এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমি পড়ছিলাম, ১৮ এপ্রিলের সপ্তাহের পত্রিকা সময় অসময়ের একটি রিপোর্ট। "সর্ব মহলে সমালোচনার ঝড়, প্রভাষক বায়েজিদ বোস্তামি কর্তৃক ছাত্রীকে বিয়ে তালাক নাটক রচনা", শিরোনামে রিপোর্টিতে এসেছে- চাটমোহর মহিলা কলেজের ইংরেজির প্রভাষক বায়েজিদ বোস্তামি তার স্ত্রী, কলেজ পড়ুয়া মেয়ে ও স্কুল পড়ুয়া ছেলে ফেলে, মেয়ে বয়সী সাবেক এক ছাত্রীকে জানুয়ারী'১১তে গোপনে বিয়ে এবং এপ্রিলে পারিবারিক চাপে ডিভোর্স দিয়েছে!
আমি ভাবছিলাম, অনৈতিক বাসনার ভীমরতি শুধু অশিক্ষিত শালিখ নয় বরং প্রভাষক শালিখেরও ঘারে রোঁ তুলতে পারে! এবং এই রোঁ'টা যদি তিন মাসের ধরা ছাড়ার নাটক হয় তাহলে একে কোনোভাবেই 'বৃদ্ধস্য তরুনী ভার্যা' বলা যাবে না,  বরং একে বলতে হবে 'বৃদ্ধস্য তরুনী বিনোদন'!
 যদিও প্রভাষক বায়েজিদ বোস্তামির এই তরুনী বিনোদন সমাজের জন্য মুখরোচক সুখপাঠ্যেরও অযোগ্য......মূল্যবোধের কি চমৎকার পরাজয়! নীতি-নৈতিকতার আশ্চর্য প্রহসন! পিতৃসম শিক্ষক যেখানে প্রেমিক পুরুষ! মহান পেশায় নিয়োজিত স্বামী কিম্বা পিতা যেখানে প্রতারক! প্রতিকুলতা জয় করে বিয়ে অতঃপর তালাকদাতা সে তো কপট দুরাচারি!
কিন্তু এতোকিছুর পরও মি. বোস্তামির যে গুন ও দোষটা আমাকে বিশেষভাবে ভাবাচ্ছে- তিনি একজন বনসাই শিল্পি। কোন এক বৃক্ষমেলায় আমি তার বনসাই দেখেছিলাম এবং মুগ্ধ হয়েছিলাম। হয়তো তার এই বিশেষ গুনেই মুগ্ধ হয়েছিলো তার সেই ছাত্রীটিও! চাটমোহরের বাস্তবতায় এ শৌখিনতাটি এক অনন্য আভিজাত্য। সম্ভবত এ শৌখিনতাটি তাকে প্রভাবিত করেছে!!! এবং তিনি কোন নির্দিষ্ট গাছের পাশাপাশি বনসাইয়ের মতো ছোট  করে ফেলেছেন, তার চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধ। বনসাই করে ফেলেছেন, তার দায়বদ্ধতা-কৃতজ্ঞতা-দায়িক্তশীলতা। সংকির্ন করে ফেলেছেন শিক্ষা ও শিক্ষকতা।
তবে আমি শংকিত, হয়তো এ বনসাই প্রক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে চাটমোহর মহিলা কলেজ! কিছুদিন আগেই শেষ হয়েছে মাধ্যমিক পরিক্ষা। আর কিছুদিন পর রেজাল্ট পরবর্তী উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির জন্য, এমন ঘটনার পর শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকেরা স্বভাবতই মহিলা কলেজের বিষয়ে আগ্রহি হবে না তখন ভাবমূর্তি সংকটের পাশাপাশি কলেজ পড়বে ছাত্রী সংকটে!
তাই এই মুহূর্তে কোন বনসাই নয় বরং বিকাশিত করতে হবে চিন্তা ও মূল্যবোধ। কারন চাটমোহরের একমাত্র মহিলা বিদ্যাপিঠ(উচ্চ) কোন ভগ্ন কলেজে পরিনত হতে পারে না!-২০এপ্রিল'১১।