মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০১৪

গেহস্ত্যর দশদিন

এ দেশে একটা প্রবাদ আছে- "চোরের দশ দিন আর গেহস্থ্যর এক দিন"।
শেষ পর্যন্ত সত্য ও সততার বিজয়কে ইংগিত করেই এটা বলা হয়ে থাকে।
কিন্তু সমস্যা হলো- বিজয়ই যেখানে শেষ কথা, গেহস্থ্য সেখানে চোরের কাছে ১০-১ এ পরাজিত! ব্যবধান ৯!
আর করুন পরিহাস হলো- বিজয়ীর শিন্ন চোষা আমাদের চেতনা, গেহস্থ্যর বিজয় কামনা করে বিজয়ী চোরের শিন্ন চুষতে চুষতে!
৫ জানুয়ারী এ দেশে যে নির্বাচনটি হয়েছে- সেটা দেশের জন্য এক সমস্যা, গনতন্ত্রের জন্য পরিহাস।
এ দেশের আপামর ভোটার বা গেহস্থ্যর দ্বারা প্রত্যাক্ষাত এ নির্বাচনে বিজয় হয়েছে কাদের?
গনতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো চোরদের! জোর যার মুল্লুক তার, মুলুকের ডাকুদের!

অনেকেই এখন বলতে পারেন- ৫ জানুয়ারীর বিজয়ীরা একটি নির্বাচিত সরকার! যারা কিনা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক ধারা রক্ষা করেছে!
এ কথার জবাব দেওয়ার আগে আমি তাদেরকেই প্রশ্ন করতে চাই- ৫ জানুয়ারী কি আপনি ভোট দিয়েছিলেন? এ দেশের আপামর জনগন কি ভোট দিয়েছিলো? অর্ধেকেরও বেশী ১৫৩ আসনের ১ জন ভোটারেরও ভোটাধিকার ছিলো?
না। আপনি ভোট দেন নি! এ দেশের আপামর জনগন ভোট দেয়নি! ১৫৩ আসনের ভোটারেরা ভোট দিতেই পারেনি! তাহলে এ সরকারকে নির্বাচিত সরকার বলেন কিভাবে?

অনেকে বলতে পারেন- ৫ জানুয়ারী আমি ভোট দিয়েছি, আমার এফ.এন.এফ.(ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলি) ভোট দিয়েছে। সর্বোপরি নির্বাচন হওয়া এলাকার প্রায় ৩৮ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে। তাই এ সরকার জননির্বাচিত সরকার।
উত্তরঃ কথাটি শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে, কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে- ৫ জানুয়ারী নির্বাচনে যদি আপনি ভোট দিয়ে থাকেন, তবে তা এ দেশের জনগন হিসাবে দেননি, একজন আওয়ামীলীগার হিসাবে দিয়েছেন! বা আওয়ামী আর্মি হিসাবে একটি একতরফা ও অগ্রহনযোগ্য নির্বাচনকে বৈধ করার বা নুন্যতম পাতে তোলার প্রচেষ্টায় শামিল হয়েছেন!
আপনি ৩৮ শতাংশ ভোটের কথা বলছেন?
সারাদিন কেন্দ্র দখল, জাল ভোটের মহোৎসব বাদই দিলাম, বিভিন্ন টিভি ক্যামেরায় ভোট কেন্দ্র ভোটার শূন্য থাকলেও ফলাফলে, যাদুকরের রুমালে ঢাকা শূন্য টুপির ভেতর থেকে 'এ্যবরা কা ড্যাবরা' ছুমন্তরে খরগোস বেরিয়েছে!
এখন চক্ষুসাফাইয়ে যাদুকর শূন্য থেকে খরগোস বের করায় সর্বোচ্চ হাত তালি পেতে পারে, সৃষ্টিকারী স্রষ্টার স্বীকৃতি পেতে পারে না।

আর সাংবিধানীক ধারা অক্ষুন্ন রাখা?
হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্ডারসনের রুপকথা ""The Emperor's New Clothes"-এ রাজা যে নতুন পোষাক পড়েছিলো, তা শুধু সৎ মানুষেরাই দেখতে পারবে! তাই অসৎ উজির-নাজিরেরা মেকি সততার চশমা পড়ে উলঙ্গ রাজার পোশাকের প্রশংসায় মেতে ছিলো! জনগনও রাজার ভয়ে ও অসততা প্রকাশের ভয়ে চুপ ছিলো! তারা সবাই দেখেছিলো- 'রাজা নেংটা'। কিন্তু তাদের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো তাদের অসততা।
রুপকথা পেরিয়ে বাংলাদেশের বাস্তবকথায়, এ দেশের মরাল ব্রিগেড আমাদের পরিয়ে দিয়েছে চেতনার চশমা। আর তাই আমারা সবাই দেখছি- ৫ জানুয়ারী আওয়ামীলীগ উলঙ্গ হয়ে গেছে! কিন্তু আমাদের চোখকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে সাংবিধানিক ধারা, দলগত পক্ষপাত এবং ব্যক্তিগত অসততা।

অনেকেই এখন বলতে পারেন- বৃহৎ দল বিএনপি এ নির্বাচনকে মেনে নিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে! মুখোমুখি অবস্থানকারী ও সংঘাত সৃষ্টিকারী রাজনীতিও বেশ স্থীতিশীল। দেশেও শান্তি বিরাজ করছে। জাতীয় পতাকা বানানোর ও জাতীয় সংগীত গাওয়ার বিশ্বরেকর্ড হচ্ছে। টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ হচ্ছে। হয়েছে প্রায় তিন শতাধিক ভারতীয় শিল্পির নাচে-গানে তার সেলিব্রেশনও! দেশ ভালোই চলছে। তাহলে সমস্যা কোথায়?
উত্তরঃ আসলে সমস্যা যে কোথায়? এটা জানতে হলে প্রশ্নটি করতে হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'দুই বিঘা জমির' উপেনকে!
শাক পাতা আচঁলে ধরা দরিদ্রমাতা যখন লুটেরার আদরে, পাঁচ রঙ্গাপাতা অঙ্গে আর পুষ্প কেশে ধারন করে! এটা গৌরব নয় বরং লজ্জার। এ লজ্জা দেবীর দাসী পরিনতির। সমস্যাটা এখানেই।
আর বিএনপির নির্বাচন মেনে নেওয়া?
এদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ ৫ জানুয়ারী নির্বাচনকে প্রত্যাক্ষান করে ভোট দেয়নি। এর মানে এই নয় যে, বিএনপির সমর্থন ব্যাঙ্কে এটি ফিকস্ট ডিপোজিট হয়ে গেছে!
আমাদের বুঝতে হবে- রাজনৈতিক দলের কন্ঠ কখনো গনমানুষের কন্ঠ হতে পারে না। বরং গনমানুষের কন্ঠ রাজনৈতিক দল ধারন করে। তাই বিএনপি যদি নির্বাচনকে মেনেও নেয়, এটা জনগনের কন্ঠ হতে পারে না। এটা, জনগনের ভোটাধিকারের কন্ঠ ধারন করতে রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপির ব্যর্থতা।
রাজনৈতিক দলের এ ব্যর্থতার সময়ে নিজেদের অধিকারের প্রশ্নে জনগনের কন্ঠকে জনগনের মধ্য থেকেই বেশী করে উচ্চারিত হতে হবে। যেখানে গেহস্থ্যর বিজয় প্রত্যাশা থাকবে তবে চোরের বিজয়কে মেনে নিয়ে নয়! চোরকে চোরই বলতে হবে। উলঙ্গ রাজাকে নেংটাই বলতে হবে। তাহলে চোরের দশ দিনের বিপরীতে গেহস্থ্যের একদিন নয় বরং চোরের একদিনের বিপরীতে গেহস্থ্যর দশদিন হয়ে উঠবে।

তবে, চোরের দশদিন আর গেহস্থ্যর একদিনই হোক কিংবা চোরের একদিনের বিপরীতে গেহস্থ্যর দশদিন(মোট এগারদিন)। আমি ভাবছিলাম- দিনের সংখ্যা বিচারে তুলনাটি যথার্থ হয়নি! এগারো সংখ্যাটি মৌলিক, তবে দিনের সংখ্যা প্যাটার্ন নয়। প্যাটার্ন অনুযায়ী দিনের সংখ্যা ৭, ১৫ কিংবা ৩০। যেমন ৭ দিনে এক সপ্তাহ, ১৫ দিনে একপক্ষ, ৩০ দিনে একমাস। লক্ষ্যনীয়, সংখ্যা হিসাবে ১১ দিনের প্যাটার্ন নয়। তাই এ প্রবাদটি হওয়া উচিত ছিলো, মৌলিক ও সংখ্যা প্যাটার্ন ৭ কে ধরে- "চোরের ছয়দিন আর গেহস্থ্যর একদিন"।

এখন পাঠক হিসাবে আপনাকে প্রশ্ন- 'চোরের ছয়দিন আর গেহস্থ্যর একদিন' হয়তো তুলনা হিসাবে যথার্থ কিন্তু এ নব্য প্রবাদের যথার্থ উদাহরন কোনটি?
আপনি যদি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে স্বামর্থ্য হন, তবে আপনাকে অভিনন্দন। আর যদি অস্বামর্থ্য হন, তবে উত্তর পেতে আপনাকে যেতে হবে পৃষ্ঠা ৩ এ! এবং পড়তে হবে "সাত বছরের চুলকানি"।

 

সাত বছরের চুলকানি

সংখ্যা হিসাবে ৭ মৌলিক। দিনের হিসাবে ৭ সপ্তাহের সংখ্যা প্যাটার্ন। নাম্বার হিসাবে ৭ লাকি। এ ছাড়াও ৭ কে নিয়ে রয়েছে নানা মাহত্ব! ৭ সমুদ্র, ৭ আসমান, ৭ মহাদেশ, ৭ নিয়েই সপ্তাচার্য, এবং বছর হিসাবে ৭ চুলকানির!
সাধারনত, দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খুটখাট লাগতে পারে, যা কিনা বিবাহ বিচ্ছেদেও গড়াতে পারে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে- বিবাহিত জীবনের ৭ বছরেই বিবাহ বিচ্ছেদ বেশী হয়! যেটাকে বলা হয় স্বামী-স্ত্রীর ৭ বছরের চুলকানী। তারা যদি এটা অতিক্রম করতে পারে তবে তাদের সম্পর্কটা টিকে যায়! টিকে যায় বলেই, পরিসংখ্যান মতে- ৭ বছরের পর পরিসংখ্যান মতে বিবাহ বিচ্ছেদ খুব কম হয়।

স্বামী-স্ত্রীর এই সাত বছরের মিথ নিয়েই হলিউডে নির্মিত হয়েছিলো, রোমান্টিক কমেডি মুভি "The Seven Year Itch"(1955) বা 'সাত বছরের চুলকানী'। যেখানে মেরিলিন মনরো অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন। এ মুভি করতে গিয়েই হঠাৎ বাতাসে উড়ন্ত কাপড়কে রক্ষা করতে চাওয়ার সাথে মোহনীয় হাসির পোজ দিয়ে ছবি তুলেছিলেন মনরো। যে ছবি দেখে মনরোর প্রেমে পড়েছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং প্রেমে পড়েছিলাম আমি নিজেও!
অর্থ্যাৎ, চুলকানীতে শুধু ৭ বছরে স্বামী-স্ত্রীই আক্রান্ত হয় না। জীবনের যে কোন পর্যায়ে চুলকানীতে আক্রান্ত হতে পারে একটি দেশের প্রেসিডেন্ট, এমনকি আমার মতো সাধারন মানুষও! এ চুলাকানীতে যেমন আক্রান্ত হতে পারে একটি দাম্পত্য সম্পর্ক, তেমনি আক্রান্ত হতে পারে একটি পত্রিকাও!
বিশেষত, যখন সপ্তাহের পত্রিকা 'সময় অসময়' ৬ বছর পেরিয়ে ৭ বছরে পা দিচ্ছে, তখন ৭ বছরের চুলকানীর মিথকে স্বরন করা অমূলক হবে না নিশ্চই। আমি আশা করছি, এ ঝুকিপূর্ন ৭ম বছরে 'সময় অসময়' যে কোন রকম চুলকানীমুক্ত বস্তুনিষ্ঠ থাকবে। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন- জীবনের যে কোন পর্যায়ে যদি চুলকানীতে আক্রান্ত হয়, তবে ৭ বছরের পরে কেন হয় না? বা ৭ বছরের পরে কেন বিবাহ বিচ্ছেদ খুব কম হয়?
উত্তরঃ সম্ভবত, ৭ বছরের পর আলাদা পরিপক্কতা তৈরী হয়। যখন চুলকানীকে প্রাধান্য দেবার সময় থাকে না। ফলে সম্পর্ক্যটি আজীবনের জন্য টিকে যায়।
আমি আশা করছি, এ ৭ম বছরে 'সময় অসময়' আলাদা পরিপক্কতা অর্জন করবে। এবং আজীবনের জন্য টিকে যাবে।
'সময় অসময়'কে টিকে থাকতেই হবে। যে পত্রিকাটা সপ্তাহের ৬ দিনের অন্যায়-অবিচারকে ১ দিনে তুলে ধরছে। শেষ পর্যন্ত সত্য ও সততার বিজয়ের এটাইতো অসাধারন রুপক! "অন্যায়কারীদের ছয়দিন আর 'সময় অসময়ের' একদিন"।
তবে টিকে থাকার লড়াইয়ে 'সময় অসময়'কে অবশ্যই ৭ বছরের চুলকানী পেরিয়ে যেতে হবে।