মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সহিংস অক্টোবর কোনদিকে যাবে?

সময়কাল-অক্টোবর ২০০৬

সেবার ঈদ উৎসবটা অনেক আগেই শুরু হয়েছিলো। যে উৎসবে বাড়ি ফেরার তাড়া ছিলো না, টিকিট কাটার লাইন ছিলো না ! বাসে ট্রেনে অস্বাভাবিক ভিড়ও ছিলো না!
তবে ঈদের মতোই খুশি ছিলো, আনন্দ ছিলো, ছিলো বিশ্বকে কিছু দিতে পারার গর্ব। একজন বাংলাদেশীর (ডঃ ইউনুস) নোবেল জয় ঈদের ঠিক ১৩ দিন আগেই পুরো জাতিকে এনে দিয়েছিল সার্বজনীন এক আনন্দের উপলক্ষ।
কিন্তু শান্তিতে নোবেল জয় এদেশের মানুষকে আনন্দিত করলেও শান্তি এনে দিতে ব্যর্থ হয়েছিলো। তাইতো সেসময় রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত হয়েছিলো, রক্তাক্ত হয়েছিলো, রাজপথ। লগি বৈঠার আঘাতে সাপের মতো মরেছিলো মানুষ। মৃত মানুষের লাশের উপর হয়েছিলো উদ্দাম নৃত্য। যে দৃশ্য হার মানিয়েছিল কোন অ্যাকশন-থ্রিলার ছবিকেও। আমি জানিনা কোন ড্রামাক্রিটিক এই দৃশ্যকে কিভাবে নিতেন।
বিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ড্রামাক্রিটিক ছিলেন কেনেথ টাইনান। উপন্যাসিক হিসেবে সমাদৃত এবং নাট্য সমালোচক হিসাবে বিখ্যাত টাইনান কখনো নাটক লেখেননি! কেন নাটক লেখেননি এমন এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন-
একজন মানুষ তার জীবনে কলম দিয়ে যা কিছু লিখতে পারে তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হলো নাটক লেখা”।
কঠিন বলেই হয়তো টাইনান নাটককে এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি বলে যাননি, আমাদের জীবনটাই একেকটা নাটক, আর সে নাটক এড়ানো সম্ভব নয়! সেটা ব্যক্তি জীবনেই হোক কিংবা জাতীয় জীবনে!
তাইতো ২৮ অক্টোবর’০৬ বাংলাদেশ এড়াতে পারেনি রাজপথের লগি বৈঠার নাটক। কোন মঞ্চ কিংবা টিভি নাটকের সাথে এ লগি বৈঠার নাটকের বৈসাদৃশ্য হলো-
টিভি নাটকে ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যে স্ট্যানম্যান ব্যবহার করা হয়। যেখানে রক্ত ঝরে না, ঝরে আলতা। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের সেই লগি বৈঠার নাটকের মানুষগুলো কোন স্ট্যানম্যান ছিলো না। লগি বৈঠার আঘাতে তাদের শরীর থেকে আলতা ঝরেনি বরং রক্তই ঝরেছিলো।

সময়কাল- অক্টোবর ২০১৪

আশ্বিন মাসের শেষ সপ্তাহ চলছে। বাংলা প্রবাদে একটা কথা আছে- আশ্বিন, গা শিন শিন। কিন্তু বৈষয়িক উষ্ণতায়, আশ্বিনে পড়ে না গা শিন শিনে শীত, সব কিছুই যে এখন সুসময়ের বিপরীত। পৃথিবীটাই তো এখন উষ্ণ হয়ে উঠছে!
সে উষ্নতাতেই ৫ জানায়ারী একটি একতরফা ও অগ্রহনযোগ্য নির্বাচনে দেশের দখল নিয়েছে আওয়ামীলীগ!
এর অভাবিত দিকটি হলো- সেই ১৯৫৮ থেকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা জাতি, ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন এবং নির্বাচন নামক তামাশাকারী গনতন্ত্র মোড়কের সৈরাচারকে মেনে নিয়েছে একরকম বিনা বাঁধায়! বালির ট্রাকেই আটকে গেছে দীর্ঘ সংগ্রামের গনতন্ত্র যাত্রা, বন্ধ করা গেছে আওয়ামীলীগের দেখানো লগি বৈঠার তান্ডব!
আমি ভাবছিলাম- তবে কি সহিংসতাই গনতন্ত্রের নিয়তি?
এ ভাবনার মাঝে আমি দেখছিলাম, আজকের দিনপঞ্চি-
আজ ২রা অক্টোবর, আন্তর্জাতিক সহিংসতা প্রতিরোধ দিবস বা আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস।
১৮৬৯ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অখন্ড- ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনীতিবিদ এবং অখন্ড- ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তি মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী।
যিনি ছিলেন সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। যে আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো অহিংস মতবাদ বা দর্শনের ওপর এবং এটি ছিলো ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম চালিকাশক্তি। সারা বিশ্বের মানুষের স্বাধীনতা এবং অধিকার পাওনায় আন্দোলনের অন্যতম অনুপ্রেরণা।
মহান এ নেতার স্মরণে ভারত সরকার দিবসটিকে গান্ধী জয়ন্তী হিসাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করলেও ২০০৭ সালে জাতিসংঘ দিবসটিকে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসাবে পালনের ঘোষণা দেয়।
এ অক্টোবরেই জন্ম নিয়ে মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী অহিংসার যে আলো ছড়িয়েছেন, সে আলো তাকে করেছিলো মহাত্মা আর বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে দিয়েছিলো ঘৃনার বিপরিতে ভালোবাসার মন্ত্র!!!
আমি ভাবছিলাম- ২০০৬ এর সহিংস অক্টোবরের বিপরিতে ২০১৪'র অহিংস ভালোবাসার মন্ত্র কি গনতন্ত্র ফেরাতে পারবে?
লেখাটি যখন লিখছি, চারিদিক থেকে ভেসে আসছে ঢাকের শব্দ। শুরু হয়েছে শারদীয়া দুর্গাউৎসব।
ছোটবেলা থেকেই যে উৎসবটা আমার অসম্ভব প্রিয়। দশমীর দিনে যে মেলা হতো, তাতে প্লাস্টিকের লাটিম পাওয়া যেতো, হাতে পেঁচিয়ে শূন্যে ছেড়ে দিলে যে লাটিম বাতাসে ঘুরে উঠতো। লোহার আলযুক্ত কাঠের লাটিম ঘোরানোর সাহস আমার তখনো হয়নি!
ছোটবেলায় ভিতু ছিলাম কিনা জানিনা, তবে কখনো হাতি দেখলে ভয়ে দৌড়ে পালাতাম। অথচ আশ্চর্য, ষষ্টীর সকালে আমি মন্দিরের সামনে ছুটে যেতাম গনেশ ঠাকুরকে দেখার প্রত্যাশায়!
আমি এখনো ছুটে যাই, তবে গনেশকে নয় দেবী দুর্গাকে দেখতে, দুর্গাদের দেখতে!!! মন্দিরের ভেতরে এক দুর্গা, বাহিরে অসংখ্য দুর্গা!!! মন্দিরে অসুর বিদ্ধ হয় ত্রিশুলে আর বাহিরে আমি বিদ্ধ হই দৃষ্টির দংশনে!!!
আমি ভাবছিলাম- অসুরও বিদ্ধ হতে পারতো দৃষ্টির দংশনে? বধ হতে পারতো ভালোবাসার মন্ত্রে? 
কিন্তু হায়! অবিচারের পাহাড়ে তৈরী হওয়া অসুরের, দৃষ্টি বিদ্ধ ভালোবাসার মন্ত্র নয় বরং দূর্গতিনাশক ত্রিশুলই প্রাপ্য।
এখন বাংলাদেশকেই বেছে নিতে হবে- ২০০৬ এস সহিংস অক্টোবর, ২০১৪য় কি রুপ নেবে সহিংসতায়? অহিংসতায়? নাকি অসুর দমনে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন